অনুরূপা দেবী

অনুরূপা দেবী (৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৮২ - ১৯ এপ্রিল ১৯৫৮) ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের একজন এক প্রভাবশালী জনপ্রিয় বাঙালি নারী ঔপন্যাসিক।[১] সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন সেই সময়কার এক বিশিষ্ট ছোটোগল্পকার, কবি এবং সেই সঙ্গে সমাজ সংস্কারকও। প্রথম প্রকাশিত গল্পের জন্য তিনি কুন্তলীন পুরস্কার লাভ করেন। পোষ্যপুত্র (১৯১১) উপন্যাসটি রচনা করে তিনি সাহিত্যজগতে প্রতিষ্ঠালাভ করেন। তার তিনটি বিখ্যাত উপন্যাস হল মন্ত্রশক্তি (১৯১৫), মহানিশা (১৯১৯) ও মা (১৯২০)। বাংলা সাহিত্যে প্রথম যে নারী কথাসাহিত্যিকেরা উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, অনুরূপা দেবী ছিলেন তাঁদেরই অন্যতম। 

১৮৮২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর কলকাতার শ্যামবাজার অঞ্চলে মাতুলালয়ে অনুরূপা দেবী জন্মগ্রহণ করেন।[৩] তার বাবা মুকুন্দদেব মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও লেখক এবং মায়ের নাম ছিল ধরাসুন্দরী দেবী। সাহিত্যিক ও সমাজ-সংস্কারক ভূদেব মুখোপাধ্যায় ছিলেন অনুরূপা দেবীর ঠাকুরদা এবং বঙ্গীয় নাট্যশালার প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তার দাদামশাই। অনুরূপা দেবীর দিদি সুরূপা দেবী (১৮৭৯-১৯২২) ছিলেন সেই সময়কার অপর এক বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার ও কবি, যিনি "ইন্দিরা দেবী" ছদ্মনামে সাহিত্য রচনা করতেন।[৪] মাত্র দশ বছর বয়সে উত্তরপাড়া-নিবাসী আইনজীবী শিখরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অনুরূপা দেবী পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। জীবনের অধিকাংশ সময় তার অতিবাহিত হয়েছিল অধুনা বিহারের মজঃফরপুর শহরে।

শৈশবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে অনুরূপা দেবীর একটু দেরিতে লেখাপড়া শুরু করেছিলেন। রোগশয্যায় শুয়েই শুয়েই তিনি দিদি সুরূপা দেবীর কণ্ঠে কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও কাশীদাসী মহাভারতের আবৃত্তি শুনতেন। এছাড়া তাঁদের পারিবারিক রীতি অনুযায়ী দুই বোনকে প্রতিদিন ঠাকুরদার কাছে বসে রামায়ণ ও মহাভারতের একটি করে অধ্যায় শ্রবণ করতে হত। তাই অনুরূপা দেবীও সহজেই বিষয়গুলি মনের মধ্যে গেঁথে নিতে পারতেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, "সেই সময় আমি নিরক্ষর হলেও অশিক্ষিত ছিলাম না। কারণ, আমি রামায়ণ ও মহাভারতের অধিকাংশ গল্পই মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। তখন আমার বয়স সাত।"

তার দিদি ঠাকুরদার থেকে শোনা সংস্কৃত কবিতা অবলম্বনে কবিতা লেখা অভ্যাস করতেন। এইভাবে তারা দুই বোনই শৈশব থেকে ঠাকুরদা ও বাবার কাছে শিক্ষালাভ করেছিলেন এবং সেই সময় থেকেই শিক্ষাগ্রহণ ও জ্ঞানার্জন বিষয়ে অনুরূপা দেবীর একটি অনুরাগ ছিল। বাংলার পাশাপাশি তিনি যথেষ্ট পরিমাণে সংস্কৃত ও হিন্দি শিক্ষালাভ করেন। তিনি বিভিন্ন পাশ্চাত্য পণ্ডিতের বহু গ্রন্থ পাঠ করেছিলেন বলে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও দর্শন সম্পর্কেও প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।

দিদি ইন্দিরা দেবীর অনুপ্রেরণায় অনুরূপা দেবী সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। প্রথম কবিতা রচনা করেছিলেন ঋজুপাঠ অবলম্বনে। রাণী দেবী ছদ্মনামে লেখা তার প্রথম গল্প কুন্তলীন পুরস্কার প্রতিযোগিতায় প্রকাশিত হয়। তার প্রথম উপন্যাস টিলকুঠী (১৯০৪) প্রকাশিত হয়েছিল নবনূর পত্রিকায়। ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত পোষ্যপুত্র উপন্যাসটি তাঁকে সাহিত্যসমাজে প্রতিষ্ঠা দান করে।

সাহিত্য রচনার পাশাপাশি অনুরূপা দেবী সমাজ সংস্কার-মূলক কাজকর্মের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। কাশী ও কলকাতায় তিনি কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং একাধিক নারীকল্যাণ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৩০ সালে অনুরূপা দেবী মহিলা সমবায় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলার নারী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।

১৯৫৮ সালের ১৯ এপ্রিল অনুরূপা দেবীর মৃত্যু ঘটে।

আরও পড়ুন
ক্যাটাগরী
বইয়ের ধারা
রেটিং
ভাষা
প্রকাশনী